উপজেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
উপজেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর |
উপজেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
- অথবা, উপজেলা প্রশাসনের বিকাশ ঘটেছে কীভাবে? লেখ।
- অথবা, উপজেলা প্রশাসনের বিকাশ সম্পর্কে বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : প্রশাসন ব্যবস্থার দিক দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ভারতে একটি শক্তিশালী লোকপ্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে দেশটির লোকপ্রশাসনে ব্রিটিশ ভারতের কাঠামোর অবিকৃত রূপ গ্রহণ করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করেছিল।
এ পরিবর্তনের একটি উদ্যোগ ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যাতে সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় ।
● উপজেলা প্রশাসন : উপজেলার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন লোকপ্রশাসনে নেই। তথাপি বাংলাদেশের লোকপ্রশাসন অধ্যয়নে উপজেলা প্রশাসন বিষয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে 'উপজেলা' সংজ্ঞাগত ধারণা থাকা দরকার।
বিভিন্ন গ্রন্থ ও আইনে বিষয়টির সংজ্ঞা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন শব্দগুচ্ছ থাকলেও সেগুলোর মূল বক্তব্য একই ধরনের।
নিম্নে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হলো : বাংলা একাডেমি অভিধান অনুসারে 'উপজেলা' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে তৎসম উপসর্গ 'উপ' এবং “জিলা' নামক শব্দযোগে। 'উপ' শব্দের অর্থ সাদৃশ্য, উৎকর্ষ, নৈকট্য প্রভৃতি।
আর 'জিলা' বা জেলা শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রশাসনিক বিভাগ, একাধিক উপজেলার সমষ্টি, বিভাগের অংশবিশেষ। উপর্যুক্ত শব্দের বিশ্লেষণ অনুসারে উপজেলা হলো জেলার সাদৃশ্য বা জেলার ক্ষুদ্রাংশ।
● উপজেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ : নিম্নে উপজেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ আলোচনা করা হলো :
স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ সালের ৬১ নং আইনের ২ নং ধারার (৭) নং উপধারায় উপজেলাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে উল্লেখ করেছে, ‘উপজেলা' অর্থ উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (১৯৯৮ সালের ২৪ নং আইন) এর অধীনে উপজেলা হিসেবে ঘোষিত এলাকা এবং সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে জেলার অধীন ক্ষুদ্র পরিসরে জেলার আদলে ক্ষুদ্র প্রশাসন সৃষ্টি করাকে উপজেলা বলা হয় ।
প্রথম পর্যায় : ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র আইন জারি করেন। মৌলিক গণতন্ত্রে আইয়ুব খান থানা পর্যায়ে যে ইউনিট গঠন করেছিলেন তাকে থানা কাউন্সিল বলা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এ থানা কাউন্সিল পরবর্তী পর্যায়ে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৭২ সালের ২৮ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু সরকার 'খানা উন্নয়ন কমিটি' নামে একটি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে সপরিবারে নিহত হলে এ ‘থানা উন্নয়ন কমিটি' অকার্যকর হয়ে পড়ে।
১৯৭৬ সালের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশের আওতায় থানা উন্নয়ন কমিটির বিকল্প হিসেবে 'থানা পরিষদ' সৃষ্টি করা হয়।
১৯৮২ সালের ২৩ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার থানা পরিষদ এবং থানা প্রশাসন পুনর্গঠন অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
এ অধ্যাদেশের আওতায় প্রথমে উন্নীত থানা পরিষদ গঠন করা হয়। এবং থানা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।
অতঃপর সংশোধনীর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা পুনর্গঠন) অধ্যাদেশ ১৯৮৩ জারি করা হয় ।
উন্নীত থানা পরিষদকে উপজেলা পরিষদে রূপ দেওয়া হয় এবং থানা প্রশাসনকে উপজেলা প্রশাসন নামে নামকরণ করা হয় ।
তৃতীয় পর্যায় : ১৯৯১ সালে স্থানীয় সরকার উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন পুনর্গঠন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের বিলুপ্তি ঘটে।
উপজেলা পরিষদ বিলুপ্তির পর ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩ সালে সরকারি নির্বাহী আদেশে প্রতিটি থানায় থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়।
এ কমিটি সংশ্লিষ্ট থানায় অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত হয়।
নামের আদ্যক্ষর অনুসারে পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণের মধ্য থেকে প্রতিমাসে একজন থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।
সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যকে কমিটির উপদেষ্টা করা হয়। কমিটির মৌলিক কার্যপরিধির মধ্যে ছিল—
ক. ইউনিয়ন পরিষদকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়া,
খ. উন্নয়ন কার্যক্রম ও প্রকল্প বাছাই, পর্যালোচনা ও সমন্বয়সাধন,
গ. আন্তঃইউনিয়ন ও আন্তঃখাত সমস্যা নিরসন ও
ঘ. উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের নিকট প্রেরণ প্রভৃতি ।
চতুর্থ পর্যায় : উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রবর্তন করার জন্য ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদে উপজেলা পরিষদ আইন পাস করা হয় ।
কিন্তু উপজেলা পরিষদের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘উপজেলা পরিষদ আইন' ১৯৯৮ বাতিলপূর্বক স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ, ২০০৮ জারি করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দেশব্যাপী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে।
জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক জারিকৃত স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ ২০০৮ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ও অনুমোদন না হওয়ায় তা বাতিল হয়ে যায় ।
পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ কর্তৃক উপজেলা পরিষদ আইন ২০০৯ প্রণয়নের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (১৯৯৮ সালের ২৪ নং আইন) পুনঃপ্রচলন করা হয়। বর্তমানে এ আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদ পরিচালিত হচ্ছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উপজেলা প্রশাসন প্রশাসনিক ব্যবস্থার একক শ্রেণিবিন্যাস । তৃণমূল পর্যায়ে সব প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়।
উপজেলার চেয়ারম্যান তথা জনপ্রতিনিধি উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে বহুবিধ ভূমিকা রাখে। কিন্তু বর্তমানে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যন ও উপজেলার অন্তর্গত সদস্যদের বিভিন্ন রকম দ্বন্দ্বের কারণে উপজেলা পরিষদের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন ব্যাহত হচ্ছে।