ইউনিয়ন পরিষদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর
ইউনিয়ন পরিষদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর |
ইউনিয়ন পরিষদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর
- অথবা, ইউনিয়ন পরিষদের গঠন ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।
- অথবা, ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : ইউনিয়ন পরিষদ হলো বাংলাদেশের প্রশাসনিক বিভাগের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক ইউনিট। সরকারের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
'গ্রাম চৌকিদার আইন ১৮৭০' এর অধীনে ১৮৭০ সালে কিছু পল্লি সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে ইউনিয়ন পরিষদের সৃষ্টি হয়।
রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হয় এবং সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা করার জন্য স্থানীয় সরকার বা প্রশাসনের প্রয়োজন হয়।
স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের জনগণের নিকট পৌঁছে যায় ।
ইউনিয়ন পরিষদের গঠন : বাংলাদেশের ১৯৯৭ সালের আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হয় এবং ইউনিয়নের জনগণের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ছোট বা গুরুতর নয় এমন বিরোধ মামলার নিষ্পত্তির জন্যই ইউনিয়ন পরিষদের সৃষ্টি।
ইউনিয়ন পরিষদ একজন চেয়ারম্যান ও ১২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ৩টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত হবেন, তবে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত সদস্যগণ বাকি আসনগুলো থেকেও নির্বাচিত হতে পারবেন।
সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যগণ একটি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হলেও সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্যগণ তিনটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এলাকা থেকে নির্বাচিত হবেন।
ইউনিয়ন পরিষদের সব কাজের দায়িত্ব চেয়ারম্যানের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং ইউনিয়ন পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদকাল ৫ বছর। একজন বেতনভুক্ত সেক্রেটারি এর সব দাপ্তরিক কাজ করেন।
ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলি : নিম্নে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলি বর্ণনা করা হলো :
ক. উন্নয়নমূলক কাজ : ইউনিয়ন পরিষদ সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, শিল্প ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য যে কাজগুলো করে থাকে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. কুটিরশিল্প ও গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়ন ।
২. পাঠাগার স্থাপন, খেলার মাঠ নির্মাণ, পার্ক ও উদ্যান নির্মাণ এবং সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা।
৩: সাধারণভাবে গাছ লাগানো ও সংরক্ষণ এবং বিশেষভাবে জনপথ, রাজপথ ও সরকারি জায়গায় গাছ লাগানো এবং তা রক্ষা করা।
৪. কুয়া, পানি উত্তোলনের কল, জলাধার, পুকুর এবং পানি সরবরাহের অন্যান্য কাজের ব্যবস্থা ও সংরক্ষণ করা।
৫. খাবার পানির জন্য সংরক্ষিত কূপ, পুকুর বা পানি সরবরাহের অন্যান্য স্থানে বা নিকটবর্তী স্থানে গোসল, কাপড় কাচা বা পশুর গোসল নিষিদ্ধ অথবা নিয়ন্ত্রণ করা।
৬. জন্মমৃত্যু নিবন্ধন এবং কবরস্থান ও শ্মশান ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ করা।
৭. অগ্নি, বন্যা, শিলাবৃষ্টিসহ ঝড়, ভূমিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তৎপরতা রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
৮. অসুস্থ দরিদ্র লোকদের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ঔষধ সামগ্রী বিতরণ করে; যেমন— কৃমিনাশক বড়ি ও গোদরোগ।
৯. বাধ্যতামূলক টিকাদান, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ, ইনজেকশন সরবরাহ ও বিতরণ, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধকাং বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।
১০. রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুল, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ এবং এগুলোর সংস্কার ও সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ এবং রাধা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
১১. প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা।
১২. ইউনিয়ন পরিষদে প্রন্থাগার ও পাঠাগারের ব্যবস্থা করা।
১৩. প্রয়োজনবোধে রাতে টহলদার ও স্থানীর গ্রাম পুলিশদের পাহারার কাজে সহায়তা করা।
১৪. জনপথ, রাজপথ ও সরকারি স্থানে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
খ. রাজস্বসংক্রান্ত কাজ : নিজস্ব দায়িত্ব সম্পাদন ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ রাজস্ব ও সাধারণ প্রশাসনিক কাজে সহায়ত করে। রাজস্ব অথবা ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ে রাজস্ব কর্মকর্তা এবং সাধারণ প্রশাসনকে সহায়তা করে।
জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অনুযায়ী ইউনিয়নের রাজস্ব ও প্রশাসন পরিচালনা, রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড ও মূল্যায়ন তালিকা প্রণয়ন সার্ভে বা শস্য পরিদর্শনে সহায়তা করে।
গ. সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ : উন্নয়নমূলক কাজ ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ কিছু সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাঠাগার স্থাপন।
বয়স্কদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা, চিত্তবিনোদনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ জাতীয় উৎসবের দিনগুলো উদযাপন, মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন, খেলাধুলা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান, মাঠ ও উদ্যানের ব্যবস্থা ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে।
ঘ. বিচারসংক্রান্ত কাজ : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসাধারণের ঝগড়াবিবাদের মীমাংসা ও মামলামোকদ্দমা নিষ্পত্তি এবং বিড়ম্বনা ও এ সংক্রান্ত খরচের হাত থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য সরকার গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিকভাবে বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের ওপর ন্যস্ত করেছে।
ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম আদালত গঠনের মাধ্যমে কতিপয় ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় প্রকার মামলার বিচার করে থাকে ।
ঙ. সরকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন : গ্রাম পর্যায়ে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব। চলাচল ও উৎপন্ন পণ্য হাটে, বাজারে নেওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ রাস্তা, পুল, কালভার্ট নির্মাণ ও সংরক্ষণ করে।
জনগণের চলাচলের সুবিধার জন্য রাস্তার পাশে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ইউনিয়ন পরিষদ তার নিজ ইউনিয়নের সমস্যাগুলো উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে সরকারকে অবহিত করবে এবং সরকার সে সমস্যা বিবেচনা করে সমাধান করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
চ. কৃষিসংক্রান্ত কাজ : ইউনিয়ন পরিষদ বাস্তব জরিপের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্যশস্য উৎপাদন, অধিক জমি চাষের আওতায় আনা এবং চাষের জমিতে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের জন্য পরিকল্পনা ও কার্যক্রম তৈরি এবং বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
প্রতিবছর ইউনিয়ন পরিষদ নিজস্ব এলাকায় সেচের জন্য খাল, বিল, পুকুর পুনঃখনন করে। কৃষকদেরকে সার ও উন্নত জাতের বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করে।
কৃষকরা যাতে উন্নত জাতের বীজ ও পোকামাকড় বিধ্বংসী ঔষধ ব্যবহার করে ইউনিয়ন পরিষদ সে প্রেক্ষিতে কর্মসূচি গ্রহণ করে ।
হ. শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা : গ্রামাঞ্চলের জনসাধারণ ও তাদের প্রাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা ইউনিয়ন পরিষদের অন্যতম দায়িত্ব।
এছাড়া ইউনিয়নের ভিতরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রতিটি মহল্লায় দফাদার ও চৌকিদার নিয়োগ করা এবং গ্রাম পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন ও পরিচালনা করা ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে মজবুত করা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, ইউনিয়নের উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজকল্যান্সমূলক কার্যাবলি ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক সম্পাদনের মাধ্যমে সরকারের কাজের চাপ লাঘব করে। স্থানীয় জনগণের সমস্যা সমাধানসহ জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।