স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর



স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর

  • অথবা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সীমাবদ্ধতাসমূহ বর্ণনা কর।
  • অথবা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ উল্লেখ কর ।

উত্তর : ভূমিকা : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন হলো স্থানীয় প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা। স্বায়ত্তশাসিত সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এবং স্বীয় প্রক্রিয়ায় পরিচালিত। 

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকা গৌণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকাই মুখ্য। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলতে একটি দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকার জনসাধারণের প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত স্ব স্ব এলাকার শাসনব্যবস্থাকে বুঝায়। 

কেন্দ্রীয় শাসনের নিম্নস্তরের গ্রাম ও শহর এলাকার নানাবিধ স্থানীয় সমস্যা থাকে। প্রত্যেক এলাকার জনপ্রতিনিধি দ্বারা গঠিত স্থানীয় সংস্থা সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় সমস্যাবলি সমাধানকল্পে বহুবিধ কাজ সম্পাদন করে ।

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ : নিম্নে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. ক্ষমতা বিভাজন নীতি : ক্ষমতার বিভাজন নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রশাসনযন্ত্রকে কতকগুলো শাখা ও কর্মক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয় । 

এ বণ্টন নীতি অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষমতা জাতীয় পর্যায়ের এবং কিছু কিছু ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ের সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয় । 

কিন্তু জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের কার্যক্রম বিভাজনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম গড়ে ওঠেনি । 

২. রাজনৈতিক অস্থিরতা : দেশের রাজনৈতিক সংকট ও অস্থিরতা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অনেক সময় মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। 

রাজনৈতিক কোন্দল, ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনে স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে । ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রভূত ক্ষতি হয় ।

৩. জনগণের অংশগ্রহণের সমস্যা : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থায় সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার কাঠামোতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ। 

অনেক সময় এটি প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের প্রভাব ক্ষেত্রে পরিণত হয় । ফলে জনগণের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে আসে ।

৪. অর্থনৈতিক সমস্যা : প্রায় সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে তাদের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য ও অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। 

জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ওপর করারোপ করতে অনীহাবোধ করে। কেননা জনগণের ওপর অত্যধিক করারোপ করলে পরবর্তী নির্বাচনে ভরাডুবির সম্ভাবনা থাকে। অধিকাংশ উপজেলা শহরাঞ্চলে পৌরসভা পড়ে ওঠায় উপজেলার আয়ের উৎস নেই বললেই চলে।

৫. পেশাগত যোগ্যতার অভাব : পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের পেশাগত দিক থেকে দক্ষতার অভাব রয়েছে। 

ফলে তারা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে অক্ষম। যার ফলশ্রুতিতে নানা ধরনের দুর্নীতি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। 

৬. নারীর অংশগ্রহণের সমস্যা : সমগ্র বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নারীরা নেতৃত্বে আসতে অনীহাবোধ করে। যে কয়েকজন এগিয়ে আসেন তারাও পুরুষশাসিত সমাজের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত। 

বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদে নারীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও সচেতনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অদক্ষতা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

৭. সরকারের নিয়ন্ত্রণ : স্বায়ত্তশাসনের মূল কথাই হলো স্বশাসন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারকে স্বাধীনভাবে তাদের শাসন চালাতে দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকায় এরা স্বশাসিত হলেও স্বাধীন নয়। 

তাদের নিয়ন্ত্রণে এসব সংস্থা পরিচালিত হয়। তবে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষণ এত বেশি থাকে যে, এটি স্বায়ত্তশাসিত সরকার না স্থানীয় সরকার তা বুঝা যায় না।

৮. সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন : সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। জালভোট, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসমূহে হরহামেশাই ঘটছে। 

যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলই নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ভোট ডাকাতির মহোৎসবে মেতে ওঠে, যা গণতন্ত্রের জন্য মোটেই শুভ নয় ।

৯. স্থানীয় সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার হবে সম্পূর্ণরূপে জনপ্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত। কিন্তু বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে স্থানীয় সংসদ সদস্যদেরকে স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। 

ফলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারসমূহ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না; বরং স্থানীয় সংসদ সদস্যদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপলাভ করছে।

১০. স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব : স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কখনোই আমলা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। 

দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের গণবিচ্ছিন্নতার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের প্রতিনিধির চেয়ে আমলানির্ভর হয়ে পড়ে বেশি। 

সরকারি কর্মকর্তাগণ নিজেদেরকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ মনে করেন। ফলে মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সাথে আমলাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব স্থানীয় সরকারকে দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত করে।

১১. স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দল : স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দল বা গ্রাম্য রাজনীতি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অগ্রগতির পথে হুমকিস্বরূপ। 

সবার সহযোগিতায়ই স্থানীয় প্রশাসনের উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হীনম্মন্যতা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের জন্য মারাত্মক হুমকি।

১২. জবাবদিহিতার অভাব : স্থানীয় সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে মূলত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় বিধায় কোনো কোনো সময় সামান্য খোঁড়া যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষ দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে বরখাস্ত করে। 

জনমতের চেয়ে দলীয় সংকীর্ণতা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ সংকীর্ণতা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সফলতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

১৩. সমন্বয়ের অভাব : কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মধ্যে যথাযথ সমন্বয়সাধনের অভাবে এ দুয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়, যা প্রকল্প বাস্তবায়ন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সুষ্ঠু তদারকির ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

১৪. পেশাগত যোগ্যতার অভাব : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থায় পেশাগত অযোগ্যতা লক্ষ করা যায় । পেশাগত অযোগ্যতার কারণে স্থানীয় অনেক সমস্যা সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা সম্ভব হয় না । সুষ্ঠু পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও ব্যাঘাত ঘটে ।

১৫. দুর্নীতি : আমাদের সমাজে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি বিরাজমান। জাতীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম দুর্নীতির প্রভাব উন্নয়নকে মারাত্মক বাধাগ্রস্ত করে।

১৬. প্রশাসনের অভ্যন্তরে সমস্যা : স্থানীয় সংস্থার কার্যক্রম দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশাসনিক পর্যায়ে স্টাফ ও লাইনের মধ্যে সমতা বিধান সম্ভব হয় না। 

ক্রমবর্ধমান বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়সাধনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে । এছাড়াও স্থানীয় সংস্থার হিসাবরক্ষণ ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৭. সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব : সুষ্ঠু পরিকল্পনা ব্যতীত জনগণের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার অন্যতম সমস্যা হলো সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব। 

সঠিক পরিকল্পনার অভাবে স্থানীয় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের নিশ্চয়তা প্রদানে ব্যর্থ হয় । সুষ্ঠু পরিকল্পনা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিশেষ বাহক হিসেবে কাজ করে ।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সমস্যার কোনো অন্ত নেই । 

তবুও একমাত্র স্থানীয় সরকারই পারে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে সেবাসমূহ পৌছে দিতে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী স্থানীয় সরকার কমিশন। 

কেননা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে স্থানীয় সরকারের সমস্যা সমাধান করতে হবে। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রতিকূলতা এ ধারাকে ব্যাহত করছে । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url