পৌরসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর
পৌরসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর |
পৌরসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর
- অথবা, পৌরসভা কী কী কার্যসম্পাদন করে? বর্ণনা কর ।
- অথবা, পৌরসভা কীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে? ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান হলো ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলাপরিষদ, যেগুলো মূলত গ্রামীণ বা পল্লি অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
অপরদিকে, শহরে স্থানীয় প্রশাসন হিসেবে কাজ করে পৌরসভা। শহর কমিটিকে পরিবর্তন করে পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এটি মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত।
পৌরসভার গঠন : পৌরসভা গঠনের জন্য চারটি বৈশিষ্ট্য বা যোগ্যতা অবশ্যই থাকতে হবে-
১. তিন-চতুর্থাংশ লোক অকৃষিজ পেশায় নিয়োজিত থাকে ।
২. শতকরা ৩৩ ভাগ লোক অকৃষিজ পেশায় নিয়োজিত থাকে ।
৩. জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫০০ জনের বেশি হতে হবে।
৪. ঐ এলাকার মোট জনসংখ্যা ৫০ হাজারের কম হবে না ।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া গেলে পৌরসভা গঠন করা যাবে । পৌরসভা নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণের সমন্বয়ে গঠিত হবে :
১. সরাসরি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত একজন মেয়র।
২. সরকার কর্তৃক সরাসরি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্বাচিত সংখ্যক ওয়ার্ডের সমসংখ্যক কাউন্সিলর থাকবেন। সরাসরি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের মাধ্যমে কাউন্সিলরগণ নির্বাচিত হবেন ।
৩. মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত নির্ধারিত সংখ্যক কাউন্সিলর থাকবেন। তারা সরাসরি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন।
৪. প্রত্যেক পৌরসভায় একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থাকেন। তিনি হলেন প্রশাসনিক প্রধান। তিনি পৌরসভার কাজের সমন্বয় ও এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করেন।
৫. মেয়রের অনুপস্থিতিতে কার্য পরিচালনার জন্য পৌরসভার কাউন্সিলরগণের মধ্য থেকে তিনজনকে অন্যান্য কাউন্সিলরগণ প্যানেল মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেন।
পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি : পৌর এলাকার উন্নয়নে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে এটির নিজস্ব কিছু ক্ষমতা রয়েছে।
নিম্নে পৌরসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন : পৌরসভা নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং সে পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরায়ণ, রাস্তাঘাট তৈরি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পাদন করে। পৌর অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা : পৌর এলাকায় মানসম্পন্ন শিক্ষাবিস্তারে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বয়স ও নিরক্ষরদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পৌরসভার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পৌরসভাভিত্তিক বিভিন্ন বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়। পড়াশুনার সামগ্রিক পরিবেশ গঠনেও পৌরসভার ভূমিকা রয়েছে।
৩. বিচারসংক্রান্ত কার্যসম্পাদন : পৌরসভা ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বিচারসংক্রান্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে। পৌর এলাকার বিভিন্ন বিবাদ ও কলহের সমাধানকল্পে পৌরসভা সালিশি আদালত গঠন করে। পৌরসভার মেয়র মূলত এ আদালতের সভাপতি হিসেবে কাজ করেন ।
৪. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন : জাদুঘর নির্মাণ, তথ্যকেন্দ্র স্থাপন, আর্টগ্যালারি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পৌরসভা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
এছাড়াও বিভিন্ন দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে নগরবাসীদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি পৌরসভা পৌর এলাকায় বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন করে।
৫. পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন : শহরবাসীদের জন্য পৌরসভা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা করে থাকে। মূলত বড় শহরগুলোতে 'ওয়াসা' এ দায়িত্ব পালন করে। পৌরসভার অন্যতম একটি কাজ হলো যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
৬. পরিবার পরিকল্পনা প্রণয়ন : পৌরসভা পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য পৌরসভা কর্তৃক নির্ধারিত একটি দল পৌর এলাকায় জনসচেতনতা গড়ে তোলে। জনগণকে এ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা প্রদান করতে পৌরসভা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৭. গৃহনির্মাণ নিয়ন্ত্রণ : শহরাঞ্চলে গৃহনির্মাণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পৌরসভা বাড়ি তৈরির অনুমোদন প্রদান করে। অপরদিকে, পৌরসভা অনুমোদনহীন বাড়ি ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। পুরাতন, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ গৃহগুলোও পৌরসভা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করে।
৮. সড়ক ও রাস্তাঘাট তৈরি : পৌরসভা পৌর এলাকার উন্নয়নে সড়ক ও রাস্তাঘাট তৈরি করে। এছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তাঘাট তৈরি, আলোর ব্যবস্থা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, সড়ক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থা পৌরসভাকে সহযোগিতা করে।
৯. উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণ : শহরে সব বয়সি মানুষের জন্য পার্ক ও উদ্যান তৈরি করে পৌরসভা। পৌর এলাকার মধ্যে জাতীয় উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণের ভার পৌরসভাকেই নিতে হয়। সরকারের অনুমোদন অনুযায়ী পৌরসভা এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে ।
১০. অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ : পৌরসভা ভিক্ষাবৃত্তি, জুয়াখেলা, কিশোর অপরাধ ইত্যাদি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যাবলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে পৌরসভার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১১. পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ : শহর এলাকায় পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কাজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নিয়োজিত থাকে। শহরের নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলে শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখা হয় ।
১২. মৌলিক অধিকার : শহর এলাকার জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন— জনস্বাস্থ্য রক্ষা, শিক্ষার প্রসার, খাদ্যের সরবরাহ, আবাসন নির্মাণে অনুমোদন ইত্যাদি ।
১৩. সমাজকল্যাণ সাধন : পৌরসভা বিভিন্ন জনহিতকর কার্যসম্পাদন করে সমাজকল্যাণ সাধন করে । সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণেও পৌরসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
১৪. জন্মমৃত্যু নিবন্ধন : পৌরসভার অন্যতম একটি কাজ হলো জন্ম ও মৃত্যু সনদ নিবন্ধন করা । এজন্য পৌরসভা এ সম্পর্কে জনগণের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলে ।
১৫. বস্তি উন্নয়ন : শহর এলাকায় বর্তমানে অনেক বস্তি পরিলক্ষিত হয়। ঐসব বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল জনগণের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৌরসভা বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে থাকে।
১৬. ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার : পৌর এলাকার ভূমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সুবিধাজনক স্থানে বিভিন্ন কলকারখানা তৈরি করা হয়। ফলে বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শহরাঞ্চলে সরকারের প্রশাসনিক কার্যাবলির ক্ষেত্রে পৌরসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্থানীয়ভাবে সরকারের কর্মকাণ্ড যেসব প্রশাসনিক বিভাগ সম্পাদন করে তার মধ্যে পৌরসভা অন্যতম। পৌর এলাকায় সরকারের নীতিমালা বাস্তবায়ন ও জনকল্যাণে পৌরসভার উন্নয়নমুখী কার্যক্রম খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।