পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি আলোচনা কর । পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর
পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি আলোচনা কর । পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর |
পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি আলোচনা কর । পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর
- অথবা, পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি বর্ণনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : পার্বত্য জেলাপরিষদ গঠিত হয় পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এ তিনটি জেলার সমন্বয়ে। পার্বত্য জেলা স্থানীয় পরিষদ, ১৯৮৯ আইনের নাম সংশোধন করে বর্তমানে পার্বত্য জেলাপরিষদ নামকরণ করা হয়।
উপজাতি অধ্যুষিত অনগ্রসর এ অঞ্চলের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন নিশ্চিত করা ও শাসনব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে বিশেষ এলাকা হিসেবে এ অঞ্চলকে চিহ্নিত করে এখানকার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে উপজাতীয় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে পার্বত্য জেলাপরিষদ গঠন করা হয় এবং এর কার্যক্রম শুরু করা হয়।
পার্বত্য জেলাপরিষদের গঠন : পার্বত্য জেলাপরিষদ ও স্থানীয় সরকার পরিষদের গঠন কাঠামোর নিয়মনীতি একই। তবে জনসংখ্যা ভারতম্যের কারণে তিনটি জেলার স্থানীয় পরিষদের সদস্যসংখ্যার কিছু তারতম্য আছে।
একজন চেয়ারম্যান এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য নিয়ে স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠিত হবে। চেয়ারম্যান উপজাতীয়দের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। তবে সদস্যদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে এ মেয়াদ গণনা করা হবে।
যেহেতু তিনটি পার্বত্য জেলায় জনসংখ্যা ও গোত্রের তারতম্য বিদ্যমান সেহেতু তিনটি জেলা তথা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদের গঠন কাঠামোগত ভিন্নতা বিদ্যমান।
পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি : পার্বত্য জেলাপরিষদ জনসাধারণের কল্যাণে বহুবিধ কাজ সম্পাদন করে। নিম্নে পার্বত্য জেলাপরিষদের কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. শিক্ষা : প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, পাঠাগার নির্মাণ, বৃত্তি প্রদান, ছাত্রাবাস নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, বয়ক্ষশিক্ষা, বিনামূল্যে বই বিতরণ, শিশু ছাত্রছাত্রীদের খাদ্য ও দুধ সরবরাহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ তত্ত্বাবধান করার পাশাপাশি আর্থিক সাহায্য প্রদান, বইপুস্তক ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করবে।
২. গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়ন : পার্বত্য অঞ্চলের শিল্পের উন্নয়নে জেলাপরিষদ গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উন্নয়নের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এছাড়াও হাটবাজার সংরক্ষণ, বাজার সৃষ্টি, গ্রামীণ দ্রব্যাদি বিক্রি ও বাজার তৈরির ব্যবস্থা করবে।
৩. উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন : পার্বত্য অঞ্চলে জনসাধারণের কল্যাণে জেলাপরিষদ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ করে। প্রকল্প প্রণয়ন করতে গিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। পার্বত্য জেলাপরিষদ শুধু পরিকল্পনা প্রণয়ন নয় তা কার্যকরের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
৪. কৃষি : কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য পার্বত্য জেলাপরিষদ কৃষি খামার স্থাপন, কৃষি শিক্ষার উন্নয়ন, বনসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, উন্নত কৃষি পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, ডোবা নালা পরিচ্ছন্নকরণ, পতিত জমির ব্যবহার, শস্য পরিসংখ্যান সংরক্ষণ, বাঁধ মেরামত ও পানি সম্পদ নিয়ন্ত্রণ এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে।
৫. আইনশৃঙ্খলা রক্ষা : পার্বত্য জেলাপরিষদ জেলার প্রশাসনিক দায়িত্বের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে থাকে। অঞ্চলভেদে চুরি ডাকাতি এবং অপরাধমূলক কাজ বন্ধের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
দাঙ্গাহাঙ্গামা, ছাত্রবিরোধ, শ্রমিক বিরোধ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিয়োগ করে।
৬. স্বাস্থ্য ব্যবস্থা : হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডিসপেনসারি স্থাপন ও পরিচালনা, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সেবিকা প্রশিক্ষণ, ম্যালেরিয়া ও সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ দেখাশুনা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ইত্যাদি কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। এছাড়াও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্য শিক্ষাবিস্তার কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
৭. পার্ক ও উদ্যান নির্মাণ : জনগণের জন্য পার্ক ও উদ্যান তৈরি করা এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করার কাজ পার্বত্য জেলাপরিষদ করে থাকে। এছাড়াও জনগণের চিত্তবিনোদনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
৮. পশুপালন ও মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন : জীবজন্তুর চিকিৎসার জন্য পশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা, পশুপালনের উন্নয়ন, পশু রোগ নির্মূল, হাঁস-মুরগির খামার স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। মাছের চাষ বৃদ্ধির জন্য সার্বিক সহায়তা প্রদান ও মাছের রোগ নির্ণয়ে পার্বত্য জেলাপরিষদ বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৯. সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উন্নয়ন : উপজাতীয় কৃষ্টি সংরক্ষণ, উন্নয়ন, ক্রীড়া ও খেলাধূলার ব্যবস্থা, চিত্র প্রদর্শনী, কমিউনিটি কেন্দ্র স্থাপন, সামাজিক শিক্ষা, জাতীয় দিবস উদযাপন, শরীর চর্চার ব্যবস্থা, ঐতিহাসিক স্থানসমূহের সংরক্ষণ, প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য তথ্যকেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি কাজ জেলাপরিষদ করে।
১০. রাজপথ ও সড়ক নির্মাণ : পার্বত্য অঞ্চলে চলাচলের সুবিধার জন্য মহাপরিকল্পনা অনুসারে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করবে। রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করে, যানজট নিয়ন্ত্রণ ও রাস্তা সড়ক সংস্কারের কাজ করে। এছাড়া এসব বিষয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
১১. সমাজকল্যাণমূলক কাজ : অনাথ দুস্থদের আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি, ভবঘুরে ও ঠিকানাবিহীনদের দাফন কাফন, জুয়া, মদ ও ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধ, দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ, সালিশের মাধ্যমে বিবাদ নিষ্পত্তি এবং সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে ।
১২. জরুরি ক্ষমতা : জরুরি বা আকস্মিক দুর্ঘটনা যেমন— প্রাকৃতিক দৈবদুর্বিপাক, বন্যা, অতিবৃষ্টি, খরা, ভূমিকম্প, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, মহামারি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে পার্বত্য জেলাপরিষদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পার্বত্য জেলা তথা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর বহুমুখী সমস্যা সমাধানের নিরিখে পার্বত্য জেলাপরিষদ কাজ করে।
জেলাপরিষদ বহুবিধ কাজ ও দায়িত্ব সম্পাদনের মাধ্যমে জেলার জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করে।
উপরোক্ত কার্যাবলি ছাড়াও জেলাপরিষদ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, জেলার শিল্পবাণিজ্যের প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও জুম চাষ, স্থানীয় পর্যটন উন্নয়ন ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে।