গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা আলোচনা কর
গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা আলোচনা কর |
গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা আলোচনা কর
- অথবা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের কার্যাবলি আলোচনা কর ।
- অথবা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম। কেন্দ্রীয় সরকারের সফল বাস্তবায়নের জন্য সুগঠিত ও জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকার আবশ্যক।
স্থানীয় সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন ও উন্নয়নের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকার নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে । কেননা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য সুশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ।
গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা : গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. জনমত : গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনমতের প্রাধান্য অনেক। সাধারণত নির্বাচনের পর জনগণ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং এ সুযোগে প্রতিনিধিগণ দায়িত্বশীল কিংবা স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ পায়।
জনগণের সচেতনতার অভাবে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায় না। স্থানীয় সরকার জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে জনমতের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় । জনমতের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের পূর্ণ চর্চা করা যায় ।
২. আইনের শাসন : উন্নয়নের জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও আইনের শাসন প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে মানুষকে সংগঠিত করার মাধ্যমে তা বহুলাংশে নিশ্চিত করা সম্ভব।
আইনের অনুশাসনের সফল বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা অপরিসীম। স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের মধ্যকার সকল বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ স্থানীয় প্রশাসন করে থাকে।
৩. শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন : বাংলাদেশের শিক্ষার হার খুব কম। অশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে স্থানীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তদারকি, ছাত্রবৃত্তি প্রদান, মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান, মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ, বয়স্ক শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার তাৎপর্যবহুল অবদান রাখে।
৪. গণতান্ত্রিক পরিবেশন সৃষ্টি : বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন করা হয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তা সুনির্দিষ্ট নির্ণয় করা, তদানুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ সবচেয়ে কার্যকরভাবে গ্রহণ করা স্থানীয় সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
৫. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : স্থানীয় সরকার বাজেট প্রণয়ন, করারোপ, ঋণ গ্রহণ, হিসাব নিরীক্ষাসংক্রান্ত কাজগুলো সম্পাদন করে। কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যায় স্থানীয় সরকারগুলো সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারি বেসরকারি সুযোগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে কারিগরি দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ আয়োজনে অনুঘটকের ভূমিকা রাখতে পারে।
৬. কৃষির উন্নয়ন : বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভিরশীল। গ্রামপ্রধান ও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের উন্নয়নে স্থানীয় সরকার অবদান রাখতে পারে।
স্থানীয় জনগণের কৃষি বীজ সরবরাহ করা, কৃষি প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণদান ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করে গ্রামের কৃষকদের সাহায্য করতে পারে এবং এভাবে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে ।
৭. সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন : টকভেলির মতে, স্থানীয় সরকার শুধু নাগরিকদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে না; বরং তাদের সঙ্গে সরকারের সেতুবন্ধ স্থাপন করে।
স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে জনগণের ওপর অধিক আস্থা স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে আয় বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় সরকারকে বরাদ্দকৃত অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কাজে লাগিয়ে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
৮. নারীর নেতৃত্ব বিকাশ : স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ রয়েছে। নারীরা নির্বাচিত হলে তারা পরিবর্তনের বলিষ্ঠ রূপকার্যে পরিণত হয়। তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আয় বৃদ্ধি প্রভৃতি মানব উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অধিক মনোযোগী হয়।
৯. প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র : স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এর মাধ্যমে উত্তরণ ঘটে।
অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র কার্যকর হয় জনগণের সরাসরি সক্রিয় ও কার্যকর সম্পৃক্ততার মাধ্যমে। প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রে প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা থাকে কিন্তু জনগণের মতামত প্রদানের পূর্ণ ক্ষমতা থাকে ।
১০. গণতন্ত্রের পক্ষে সহায়ক : জাতীয় সরকারের তুলনায় স্থানীয় সরকার অনেক বেশিসংখ্যক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করতে পারে। এটি গণতন্ত্রকে আরও বেশি অর্থবহ করে তোলে।
স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। যে কারণে স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রের রক্ষাকারী হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১১. সিদ্ধান্ত গ্রহণ : স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোন প্রকল্প অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নেওয়া উচিত এবং কোনটি নেওয়া উচিত নয় তা সংশ্লিষ্ট সরকার প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
পরিবেশ দূষণরোধ, সমাজের যুবক যুবতিদের মাদকের কবল হতে রক্ষা করা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে স্থানীয় সরকার উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে।
১২. সচেতনতা বৃদ্ধি : নির্বাচনি প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, নেতৃত্বদান, সভাসমাবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার সচেতনতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও নারীনির্যাতন, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, জন্ম ও বিবাহ নিবন্ধীকরণ, মাদকাসক্তি প্রভৃতি দুরূহ সামাজিক সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিগণ জনগণকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করে।
১৩. জনহিতকর কার্যাবলি : স্থানীয় সরকারগুলো বিভিন্ন জনহিতকর কর্মসম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেমন— বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, জনস্বাস্থ্য রক্ষা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্র হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান থাকবে।
কিন্তু স্বাধীনতার চার দশকেও বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি । কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা সংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।
Vcff