স্থানীয় সরকার কাঠামোর বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
স্থানীয় সরকার কাঠামোর বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর |
স্থানীয় সরকার কাঠামোর বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
- অথবা, স্থানীয় সরকার কাঠামোর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর ।
- অথবা, স্থানীয় সরকার কাঠামোর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কাঠামোর ইতিহাস দীর্ঘ। প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এক দীর্ঘ সময়ের পথ অতিক্রম করে স্থানীয় সরকার কাঠামো বর্তমানের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
স্থানীয় জনসাধারণের চাহিদা পূরণ, স্থানীয় সমস্যা সমাধান এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন।
সময়ের পরিবর্তনের ধারায় স্থানীয় সরকার কাঠামোতে নানাবিধ পরিবর্তন সাধিত হয় বিধায় এর কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্থানীয় সরকার কাঠামোর বৈশিষ্ট্য : নিম্নে স্থানীয় সরকার কাঠামোর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো :
১. আইনগত ভিত্তি : স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য স্বশাসনের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তাই বিভিন্ন প্রকার সরকার ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারের আইনগত ভিত্তিও ভিন্নরকম হয়ে থাকে।
যেমন— যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক বিষয়ে সুযুক্ত ব্যবস্থাদি প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক হয়ে থাকে। এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্র কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
তবে যেভাবেই গড়ে উঠুক না কেন সাংবিধানিক আইনের ধারা অনুসারেই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। নইলে তা স্থায়ী ও কর্মক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদা পাবে না ।
২. যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সরকার কাঠামো : যুক্তরাজ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাগুলো পার্লামেন্ট প্রণীত আইনে সৃষ্ট এবং পরিচালন ব্যবস্থাও এ আইনে স্থির করা হয়।
যেমন- মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অ্যাক্ট ১৮৮২ এবং Local government act. ১৮৮৮ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ফ্রান্স স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়, তাই তাদের নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পার্লামেন্ট প্রণীত আইন ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে সৃষ্ট ও পরিচালিত।
৩. সাংগঠনিক কাঠামো : সরকারের মর্যাদা পেতে হলে অবশ্যই সাংগঠনিক কাঠামো থাকতে হবে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বার বার পরিবর্তিত হলে সত্যিকার স্বশাসনে মর্যাদা থাকে না।
ইংল্যান্ডে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ৬টি স্তরবিশিষ্ট; যথা : প্যারিস, আরবান ডিস্ট্রিক্ট, Rural District, Counts Boro ইত্যাদি।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে এগুলো সৃষ্টি হয় এবং সংশোধিত আইনে পরিবর্ধনও করা হয়েছে তবে আমূল পরিবর্তন সাধন হয়নি।
আইনের মাধ্যমে ১৮৮৪ সালে ফালে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সৃষ্টি হলেও অব্যাহত গতিতে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্তন হয়েছে আবার কখনও কখনও আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কাঠামোগত স্বীকৃতির জন্য অবশ্যই সাংগঠনিক কাঠামোগত ভিত্তির প্রয়োজন রয়েছে।
৪. কর্মকর্তা-কর্মচারী : স্থানীয় সরকারের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো এর নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী, যা স্টাফ থাকবে।
স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকবে এবং এদের নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি স্থানীয় সরকারের আওতাধীন থাকবে।
যুক্তরাজ্য স্থানীয় কর্মচারী পার্লামেন্ট প্রণীত আইনে নির্ধারিত হলেও বাস্তবায়িত হয় স্থানীয় সরকারের কর্তৃপক্ষের দ্বারা। ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে অনেক কর্মকর্তা নির্বাচিত হন।
স্থানীয় সরকারের সাথে যুক্ত থাকেন কিন্তু এর প্রতিনিধিদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করার চেষ্টা করেন না। বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের একমাত্র সরকারি কর্মকর্তা হলেন সচিব।
ইউনিয়ন পরিষদ তার মাসিক বেতনের অর্ধেক প্রদান করলেও তার ওপর ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ন্ত্রণ খুবই সীমিত ।
৫. অর্থনৈতিক সামর্থ্য : প্রত্যেকটি দেশের সফলতা নির্ভর করে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ওপর। স্থানীয় সরকার হচ্ছে জাতীয় সরকারের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ।
তাই এখানে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্থানীয় সরকার পরিচালনার জন্য নিজস্ব অর্থায়নের ব্যবস্থা রয়েছে।
ইংল্যান্ডে স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের একক হিসেবে বাজেটের একটি অংশ পায় এবং নিজস্ব এলাকার বিভিন্ন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে।
তবে আয়ের বেশিরভাগ অংশ পায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা কখনও সচ্ছল ছিল না।
নিজস্ব অর্থায়নের তেমন কোনো উৎস না থাকার কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভর করছে সবসময়, সেই সাথে যুক্ত করা হয়েছে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব।
নিজস্ব তহবিল সৃষ্টির জন্য কয়েকটি খাত নির্ধারণ করে দিলেও তা থেকে করারোপের পরিমাণ ছিল অতি সামান্য । তাই বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারগুলো সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসনের স্বাদ বঞ্চিত হয়েছে।
৬. নির্বাচন : স্থানীয় সরকার কাঠামোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিনিধিগণ হবেন জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত। কারণ সরকার কর্তৃক মনোনীত কর্মকর্তা দ্বারা কোনো প্রতিষ্ঠান স্বায়ত্তশাসিত হতে পারে না।
ইংল্যান্ডের স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের কোনোটিতে প্রতিনিধিগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও অনেক ক্ষেত্রে মনোনয়নের মাধ্যমে নিয়োজিত হয়।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের অধিকাংশ স্তরে প্রতিনিধিদের মনোনয়নের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয় ।
মনোনয়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার চালানোর চেষ্টা করলে সেখানে দলীয় প্রভাব আসবেই, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকরী করতে নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।
৭. কর্মপরিধি : স্থানীয় পরিষদগুলোর কর্মপরিধি যতটুকু হবে তা নির্ধারিত থাকতে হবে। কারণ স্থানীয় পরিষদকে বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক দুই প্রকারের কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। উভয় প্রকার কার্যাদি স্থানীয় এলাকায় উন্নয়নের সাথে জড়িত।
তবে স্থানীয় পরিষদগুলো যেসব কার্যাদি সম্পাদন করে তা অবশ্যই আইনসভা কর্তৃক পাসকৃত অ্যাক্টের বলে ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে সম্পাদন করলে তাতে ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তবে ক্ষমতা বণ্টন করলে যাতে কারো সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হয় তার ওপর লক্ষ রাখতে হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হলো স্বশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন আইনগত ভিত্তিতে শাসন পরিচালনা করা এবং জনগণের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা। স্থানীয় সরকার কাঠামো উপর্যুক্ত শর্তের ওপর গড়ে ওঠলে তার উদ্দেশ্যের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব।
কেননা স্থানীয় সরকার হলো জনগণের সরকার। তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অপরিসীম।