বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে প্রবর্তিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে প্রবর্তিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, বেগম খালেদা জিয়া স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন এনেছে তা ব্যাখ্যা কর ।
- অথবা, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে প্রবর্তিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় আসে।
৫ বছরের শাসনকালে বিএনপি সরকার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কাঠামোর বিবিধ পরিবর্তন করেন। এরশাদ সরকারের প্রবর্তিত অনেক স্থানীয় পরিষদ বাতিল করে নতুন করে প্রবর্তন করেন ।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে উপজেলাকে বাতিল করে তার স্থলে থানাকে পুনর্বহাল করা হয় এবং ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। এসময় গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে প্রবর্তিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা : নিম্নে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে প্রবর্তিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. গ্রাম সরকার : প্রবর্তন ও ইউনিয়ন পরিষদের সংস্কারের প্রস্তাব বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই পুনরায় গ্রামীণ সমাজে জিয়াউর রহমান কর্তৃক সৃষ্ট 'গ্রাম সরকার' চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করে।
বিএনপি এসময় গ্রামকে প্রশাসনের মূল ইউনিট ধরে স্থানীয় সরকার বিকাশের প্রচেষ্টা চালায়। কাঠামোগত দিক হতে এটি ছিল অভিনব।
কেননা প্রায় একশ বছ ধরে ইউনিয়ন পরিষদ ছিল প্রশাসনের মূল স্তর। খালেদা জিয়ার সরকার একটি কার্যকরী স্থানীয় সরকার বিকাশের লক্ষ্যে
"স্থানীয় সরকার পর্যালোচনা কমিশন' গঠন করে। কমিশন ইউনিয়ন পরিষদের বদলে প্রশাসনের মূল স্তর হিসেবে 'গ্রামসভা' বা 'গ্রাম পরিষদ' গঠনের সুপারিশ করেন।
মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য মত প্রকাশ করে যে, গ্রামসভা গঠিত হলে গ্রামে দলাদলি বা কোন্দলের রাজনীতির বিস্তৃতি ঘটবে। যদিও ইউনিয়ন পরিষদের কাজ তদারকির জন্য 'গ্রাম উন্নয়ন কমিটি' গঠনের কথা বলা হয়।
২. উপজেলা পরিষদ : উপজেলা পরিষদ প্রবর্তনের সূচনালগ্ন হতে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাচনে সে বিতর্ক আরও বেগবান হয়। বিএনপি সরকার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত দলীয় সভায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ বিলোপ করার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৪ নভেম্বর ১৯৯১ স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৯১' জারির মাধ্যমে উপজেলা ব্যবস্থা বিলুপ্তি ঘটানো হয়।
বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট যে স্থানীয় সরকার কাঠামো পর্যালোচনা কমিশন গঠন করে তাদের টার্মস অব রেফারেন্স এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উপজেলা গঠন, কাঠামো, দায়িত্ব, স্থানীয় উপজেলা পরিষদের প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা ইত্যাদি।
এ কমিশন দীর্ঘ ৮ মাস পর ৩০ জুলাই ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে রিপোর্ট পেশ করা হয় তাতে উপজেলা পরিষদের পুনরুজ্জীবনের সুপারিশ ছিল না।
বরং উপজেলা পরিষদের পরিবর্তে থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। ২২ জানুয়ারি ১৯৯২ খ্রি. উপজেলা পরিষদ বাতিলসংক্রান্ত বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয় এবং বিরোধী দলের তীব্র বিরোধিতার মুখে ২৬ জানুয়ারি ১৯৯২ খ্রি. ভোটে বিলটি সংসদে পাস হয়।
৩. থানা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটি : বিএনপি সরকার স্থানীয় সরকার পুনর্বিন্যাস কমিটির সুপারিশ অনুসারে Thana Development and Co-ordination Committee' গঠন করে।
কমিশনের মতে উক্ত কমিটি নিজ নিজ থানার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের সমন্বয় করবে এবং উন্নয়ন কাজের পর্যালোচনা করবে। এছাড়া এ কমিটি ইউনিয়ন পরিষদে ও জেলা পরিষদের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধন রচনা করবে।
৪. জেলা পরিষদ : বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে স্থানীয় সরকার পুনর্মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জেলা পরিষদের গঠন নিম্নরূপ :
ক. একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান (পরোক্ষ ভোটে) ।
খ. প্রত্যেক থানা থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারের দ্বারা নির্বাচিত ২ জন প্রতিনিধি ।
গ. ৩ জন মহিলা প্রতিনিধি যারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার দ্বারা নির্বাচিত হবেন।
ঘ. জেলার অন্তর্গত ইউনিয়ন গ্রামসভার সদস্যবৃন্দ, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার এর সমন্বয়ে গঠিত একটি নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন।
৫. 'মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, ১৯৯৬ : ১৯৮৯ সালের ২৬ অক্টোবর একটি পৌর কমিশন গঠন করা হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে প্রধান করে বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক মিটিং এবং জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উক্ত কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশন অনেক আনুষ্ঠানিক বৈঠক, ১১টি ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং ৪টি পূর্ণাঙ্গ কমিশন মিটিং শেষে ১৯৯০ এর ডিসেম্বরে তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে।
পৌর কর্পোরেশনের সুপারিশসমূহ এরশাদের পতনের কারণে কার্যকর হয়নি। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র পদ বাতিল করেন।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার আইন অ্যাক্ট ১৯৯০ এর মাধ্যমে, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনসমূহের নামকরণ করেন সিটি কর্পোরেশন।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে বিজয় লাভ করে ১৯৯১ সালের মার্চে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বিএনপি সরকার ৪টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে মনোনয়ন দান করেন।
বিরোধী দল এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বিএনপি সরকার ১৯৯২ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে জাতীয় সংসদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন বিল ৯২ পাস করেন।
এতে কার্যকাল ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে ৫ বছর এবং নির্বাচনের ফলাফল গেজেট প্রকাশের সাথে সাথে কর্পোরেশন পুনর্গঠন এবং কার্যভার গ্রহণ করার বিধান রাখা হয়।
পরবর্তীতে সরকার ১৯৯৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে জাতীয় সংসদে ৪টি সিটি কর্পোরেশন সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ১৯৯৩ পাস করান। এতে সকল সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন জোনে বিভক্ত হবে, যার সংখ্যা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে স্থানীয় সরকারের পরিষদসমূহকে সংস্কার করা হয় । গ্রাম সরকার প্রবর্তন ও ইউনিয়ন পরিষদের সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো পরিবর্তনই স্থানীয় ব্যবস্থায় কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারেনি। এছাড়াও এ শাসনকালে উপজেলা পরিষদ বাতিলকরণ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।