বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের প্রধান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত কর
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের প্রধান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত কর |
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের প্রধান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত কর
- অথবা, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের প্রধান সমস্যাগুলো উল্লেখ কর।
- অথবা, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের প্রধান সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : স্থানীয় সরকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি বিশেষ পদক্ষেপ। স্থানীয় সরকারকে ইংরেজিতে লোকাল গভর্নমেন্ট বলা হয়। স্থানীয় সরকার বলতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসনকে বুঝায়, যা কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সম্প্রসারিত অংশ।
দেশের সার্বিক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা ও তাৎপর্য অপরিসীম। জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এ সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। বাংলাদেশের ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান ।
● বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের প্রধান সমস্যা : নিম্নে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হলো :
১. কাঠামোগত সমস্যা : স্থানীয় সরকারের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে প্রশাসনিক কাঠামোগত সমস্যা। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামো ও নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ আইন অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত থাকলেও দুর্বল প্রশাসনিক যোগ্যতা, জনগণের অংশগ্রহণহীনতা স্থানীয় সরকারকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে ।
২. জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব : স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কখনোই আমলা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশীল।
কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের অদক্ষতা, অযোগ্যতার কারণে জনগণ আমলানির্ভর হয়ে পড়ছে। ফলে মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সাথে আমলাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব স্থানীয় সরকারকে দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছে।
৩. দায়বদ্ধতার অভাব : স্থানীয় সরকার মূলত কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি স্থানীয় সরকার বরাবরই দায়বদ্ধ থাকে। এক্ষেত্রে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হতে স্থানীয় সরকার অনীহা প্রকাশ করে।
৪. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ : স্থানীয় প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থানীয় সরকারের মূল কাঠামোতে আঘাত করে, যা স্থানীয় কার্যক্রমে ব্যাপক বাধা হয়ে দাঁড়ায় ।
৫. কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত : স্থানীয় সরকারগুলো সর্বদা কেন্দ্রীয় সরকার ও ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই এ প্রশাসন কাঠামো সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। কেন্দ্রীয় শক্তি স্থানীয় সরকারকে দিনদিন নির্ভরশীল করে তুলছে।
৬. অর্থনৈতিক সমস্যা : স্থানীয় সরকারগুলোর কার্যক্রম দিনদিন বৃদ্ধি পেলেও সংস্থাগুলোর সম্পদ তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। স্থানীয় সরকার মূলত পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। আর্থিক সমস্যার কারণে স্থানীয় সরকারগুলো সুষ্ঠুভাবে তাদের কাজ করতে সক্ষম হয় না।
৭. জনগণের অংশগ্রহণের অভাব : রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনেক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন স্থানীয় সরকার কাঠামোতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ। সরকার কাঠামোতে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের প্রভাবের কারণে জনসাধারণের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে আসে।
৮. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সমস্যা : কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার। অনেক ক্ষেত্রে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে উপবিধি তৈরি করে।
কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের অদক্ষতা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়াও নানামুখী সমস্যার কারণে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।
৯. সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ : স্থানীয় প্রশাসনগুলোতে সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ অন্যতম একটি সমস্যা। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ ও খবরদারিত্ব তৃণমূল পর্যায়ের সংস্থাগুলোকে সুষ্ঠুভাবে কার্যসম্পাদনে ব্যাহত করছে।
১০. নারীর অংশগ্রহণের সমস্যা : বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। কিন্তু নারীরা নেতৃত্বে আসতে বরাবরই অনীহা বোধ করে । যে কয়েকজন এগিয়ে আসেন তারাও পরুষ শাসিত সমাজের প্রভাবে কার্যকর প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না ।
১১. দক্ষ কর্মচারীর অভাব : সরকারি কাজকর্ম দক্ষভাবে প্রতিপালনের জন্য স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মচারী নিয়োগ করাও একটা সমস্যা বলে প্রতিপন্ন হয়।
স্থানীয় সরকারের জন্য দক্ষ কর্মচারী পাওয়া কঠিন ব্যাপার। স্থানীয় পর্যায়ে কর্মচারীদের প্রশিক্ষণেরও তেমন সুযোগ নেই। ফলে দক্ষ কর্মচারীর মারাত্মক সমস্যা দেখা যায় ।
১২. সমন্বয়ের অভাব : স্থানীয় সংস্থাসমূহে নির্বাচিত, আধানির্বাচিত এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব লক্ষ করা যায়।
স্থানীয় সংস্থাগুলোকে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। নির্ভরশীলতা কর্মকর্তাদের মধ্যে অভিভাবক সুলভ মনোভাবের জন্ম দেয়। ফলে স্থানীয় সংস্থার কার্যক্রম ব্যাহত হয় ।
১৩. ক্ষমতা বিভাজন নীতি : ক্ষমতা বিভাজন নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রশাসনযন্ত্রকে কতকগুলো শাখাপ্রশাখায় ভাগ করা হয়। কিছু ক্ষমতা স্থানীয় সরকারের হাতে, কিছু ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, কিন্তু ক্ষমতা বিভাজনের ক্ষেত্রে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই । স্বইচ্ছায় বিভাজন করা হয়। যার ফলে ক্ষমতার সফল প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয় ।
১৪. প্রশাসনিক সমস্যা : স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রশাসনিক সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। প্রশাসনের অভ্যন্তরে কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়গত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও বড় বিভাগের কাজ জটিলতর হচ্ছে। অদক্ষ কর্মীদের কারণে অর্থনৈতিক বিভাগে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্থানীয় সরকারের সমস্যার অন্ত নেই। তবুও একমাত্র স্থানীয় সরকারই পারে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কাছে সেবাসমূহ পৌঁছে দিতে।
মানবাধিকার সংরক্ষণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকার কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
তবে তার জন্য দরকার সত্যিকারের ক্ষমতা হস্তান্তর ও সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক্তিয়ার। স্থানীয় সরকারের সার্বিক সমস্যা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী স্থানীয় সরকার কমিশন