বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর
বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর |
বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, জেলা প্রশাসনের বিকাশ ঘটেছে কীভাবে? লেখ।
- অথবা, জেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ বর্ণনা কর।
ভূমিকা : সর্বস্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
'জেলা প্রশাসন' বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের প্রথম স্তরের একটি প্রতিষ্ঠান। এবং আইনের মাধ্যমে সংবিধিবদ্ধ।
বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার ইতিহাস স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেলা বোর্ড, জেলা কাউন্সিল হয়ে বর্তমানে জেলাপরিষদ নাম ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের ক্রমবিকাশ : বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার বিবর্তনের ইতিহাস নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ক. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল : ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের বিবর্তন নিম্নরূপ :
১. জেলা প্রশাসনের উদ্ভব : প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের একটি স্তর হিসেবে 'বেঙ্গল রোড সেস' আইনের মাধ্যমে ১৮৭৯ সালে জেলার উদ্ভব হয়। এ আইন অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় কমিটি গঠন করা হয়।
এখানে জেলা প্রেসিডেন্ট জেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে নির্ধারিত হয়। এটিই সর্বপ্রথম জেলা পর্যায়ে স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
এ কমিটি সড়ক নির্মাণ, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করাসহ বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর কাজ সম্পাদন করতো। এখানে জনসাধারণের মতামত প্রকাশের সুযোগ ছিল না।
২. সংস্কারমূলক পদক্ষেপ : স্থানীয় প্রশাসনে স্বায়ত্তশাসন দৃঢ় করার লক্ষ্যে 'বেঙ্গল লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট- ১৮৮৫' পাস হয়। এ আইন অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় বোর্ড গঠিত হয়।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। বোর্ডের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন বলে আইনে উল্লেখ থাকলেও সব সদস্যই ছিলেন মনোনীত ।
৩. বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে জেলা প্রশাসন : ১৯০৭-০৯ সালের হব হাউজ কমিশন, ১৯১৩-১৪ সালের লিভিঞ্জ কমিটি এবং ১৯১৮ সালের মন্টেগু চেমস ফোর্ট প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সংগঠিত করার জন্য ১৯১৯ সালে 'বেঙ্গল ভিলেজ সেলফ গভর্নমেন্ট' আইন পাস হয়। এ আইন অনুযায়ী জেলা বোর্ডের সদস্যদের পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হতো।
৪. ব্রিটিশ আমলের পরিসমাপ্তি : ঔপনিবেশিক আমলের শেষভাগে ব্রিটিশরা জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্কার সাধন করেন। যেমন— সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না বলে ১৯৩৬ সালে লোকাল বোর্ড বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে জেলা বোর্ডের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য জেলার ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হতো। এক-তৃতীয়াংশ সদস্য ছিল মনোনীত।
১৯৪৪-৪৫ সালে রোল্যান্ড কমিটি মনোনয়ন পদ্ধতি বাতিল ও নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের সুপারিশ করলেও ব্রিটিশ আমলের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত মনোনয়ন পদ্ধতি অব্যাহত ছিল।
খ. পাকিস্তান আমল : মৌলিক গণতান্ত্রিক আদেশ, ১৯৫৯ অনুযায়ী জেলা পর্যায়ে স্থানীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। জেলা বোর্ডের নামকরণ করা হয় জেলা কাউন্সিল।
এটি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হতো। জেলা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন জেলা প্রশাসক।
১৯৬২ সালে পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৫০ শতাংশ সদস্য নির্বাচিত করা হয়। বাকি ৫০ শতাংশ সরকারি সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে জেলা কাউন্সিল গঠন করা হয়।
গ. বাংলাদেশ আমল : স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জেলা কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জেলা বোর্ড এবং জেলা প্রশাসককে জেলা বোর্ডের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। জেলা বোর্ডের যাবতীয় কার্য তিনি পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশ আমলে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. স্বাধীনতাপরবর্তীকালে জেলা প্রশাসন : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে জেলা বোর্ডের কোনো কমিটি ছিল না । প্রশাসক ও সচিব উভয়ই ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা।
প্রশাসক ছিলেন সব ক্ষমতার অধিকারী। এটি মূলত সরকারের একটি শাখা ছিল, যেখানে স্বয়ং শাসনের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না।
২. রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব : ১৯৭৫ সালে সবগুলো মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব গভর্নরের নেওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে জেলা গভর্নর পদ বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে এক সরকারি ঘোষণায় জেলা প্রশাসনের কার্যাবলি পরিচালনা ও সমন্বয়সাধনের জন্য জেলা প্রশাসকের ওপর ক্ষমতা অর্পণ করা হয় ।
৩. নির্বাচনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অধ্যাদেশ জারি : ১৯৭৬ সালে 'স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৭৬' জারি করা হয়, যেখানে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে জেলাপরিষদ গঠন করা হবে এবং নির্বাচিত চেয়ারম্যান যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বলে উল্লেখ করা হয়।
নির্বাচিত জেলাপরিষদের কার্যকাল হবে পাঁচ বছর। কিন্তু বাস্তবে অধ্যাদেশ অনুযায়ী জেলাপরিষন পঠন করা হয়নি। তখনো জেলা প্রশাসক জেলার সব কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
৪. ৮০ এর দশকে জেলা প্রশাসন : ১৯৮০ সালে জেলাকে জনপ্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য প্রতি জেলায় একজন সংসদ সদস্যকে জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
সাধারণ জনগণ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করার দায়িত্বও ছিল সমন্বয়কারীর ওপর। ১৯৮২ সালে প্রশাসন পুনর্বিন্যাস কমিটি গঠন করা হয়।
ঐ কমিটির মাধ্যমে জেলাপরিষদ নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য প্রশাসন পুনর্গঠন বা সংস্কার জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) গঠন করা হলেও জেলাপরিষদ গঠন করা হয়নি।
৫. জেলাপরিষদ বিল ও সংস্কার সাধন : ১৯৮৬ সালে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে জেলাপরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালের ১২ জুলাই স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) বিল' ১৯৮৭ সালে পাস হয়।
এ আইনের মাধ্যমে সামরিক সদস্যদের জেলাপরিষদে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ বিলটি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়।
সরকার এ বিলটি স্থগিত করতে বাধ্য হয়। আবার সংসদ পরিবর্তন হলে ১৯৮৮ সালে স্থানীয় সরকার (জেলাপরিষদ) আইন ১৯৮৮ পাস হয়।
৬. ৯০ এর দশকে জেলা প্রশাসন : ১৯৯০ সালে সরকার পতনের পর মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে জেলা প্রশাসকদেরকে জেলাপরিষদের অস্থায়ী চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করা হয়।
এ ব্যবস্থা ১৯৯১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বহাল থাকে। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের আদেশের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসককে চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং চেয়ারম্যান নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত পরিষদের সচিবকে জেলাপরিষদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৯৩ সালে ‘জেলাপরিষদ বিল ১৯৯৩° উত্থাপন করা হয়। কিন্তু বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করলে বিলটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
৭. একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জেলা প্রশাসন : ২০০০ সালের ৬ জুলাই ১৯৮৮ সালের আইন বাতিল করে 'জেলাপরিষদ আইন ২০০০' প্রণয়ন করা হয়, যেখানে পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদ গঠন করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
জেলাপরিষদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০০৫ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের আদেশ অনুযায়ী জেলাপরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী জেলাপরিষদ গঠন করা হয়নি।
২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া দেশের অবশিষ্ট ৬১টি জেলায় জেলাপরিষদ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ আমল থেকে জেলা একটি প্রশাসনিক একক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যা পরবর্তী সময়ে প্রধান প্রশাসনিক এককে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয়নি। তবে নীতিগত ও আইনগতভাবে জেলা পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বশীল পরিষদ গঠনের বিধান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সব সরকারের সময়েই জেলাপরিষদে জেলা প্রশাসক বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।