বাংলাদেশের জেলা পরিষদ কি প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ব্যাখ্যা কর
বাংলাদেশের জেলা পরিষদ কি প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ব্যাখ্যা কর |
বাংলাদেশের জেলা পরিষদ কি প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ব্যাখ্যা কর
- অথবা, বাংলাদেশের জেলাপরিষদ কতটুকু স্বায়ত্তশাসিত? বর্ণনা কর।
- অথবা, বাংলাদেশের জেলাপরিষদ কি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশে তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জেলাপরিষদ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। জেলাপরিষদ সংশোধিত আইন ২০১৬ অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য এবং ৫ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্যসহ মোট ২১ তানের সমন্বয়ে জেলাপরিষদ গঠিত।
জনগণের সরাসরি ভোটে জেলাপরিষদ গঠনের পরিবর্তে জেলার অভ্যন্তরীণ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
© জেলাপরিষদের গঠন : স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভোটে গঠিত হয় জেলাপরিষদ। জেলাপরিষদ সংশোধিত আইন, ২০১৬ অনুযায়ী জেলাপরিষদ গঠিত হবে চেয়ারম্যানসহ ২১ সদস্যের সমন্বয়ে। এ পরিষদে ১৫ জন সাধারণ সদস্য ও পাঁচজন সংরক্ষিত আসনের সদস্য থাকে।
চেয়ারম্যান : সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকার কর্তৃক জেলাপরিষদের চেয়ারম্যানকে নিযুক্ত করেন। এছাড়াও উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে জেলাপরিষদের চেয়ারম্যানসহ ২১ সদস্যের পরিষদ গঠন করে।
কর্মকর্তা সদস্য : সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংশ্লিষ্ট জেলায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে জেলাপরিষদের কর্মকর্তা সদস্য নিযুক্ত হন।
তবে জেলাপরিষদের কোনো সভায় কোনো কর্মকর্তা ও সদস্যগণ ভোট দিতে পারেন না। প্রত্যেক জেলাপরিষদের সরকার কর্তৃক একজন বেতনভুক্ত সেক্রেটারি আছেন এবং সব দাপ্তরিক কার্যক্রম তিনি সম্পাদনা করেন।
প্রতিনিধি সদস্য : সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্যগণ, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, পৌরসভার মেয়রগণ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে জেলাপরিষদের প্রতিনিধি সদস্য হন।
মনোনীত ও মহিলা সদস্য মনোনীত ও মহিলা সদস্যগণ সংশ্লিষ্ট জেলায় বসবাসরত পুরুষ ও মহিলাদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক মনোনীত হন এবং তাদের সংখ্যা প্রতিনিধি সদস্যদের সংখ্যা থেকে বেশি হয় না ।
বাংলাদেশের জেলাপরিষদ প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কি না : বাংলাদেশের জেলাপরিষদ প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কি না তা যাচাই করার পূর্বে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার হচ্ছে সরকার কর্তৃক বিভক্ত রাষ্ট্রের সেই ক্ষুদ্র একক, যেখানে স্থানীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি সংস্থা থাকে এবং সে সংস্থার দায়িত্বে থাকেন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ।
এ প্রতিনিধিগণ তাদের কাজের জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য। তাছাড়া প্রয়োজনে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিকটও জবাবদিহি করেন ।
বাংলাদেশের সংবিধানে আইনসংগত উপায়ে গঠিত নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে উপর্যুক্ত সংজ্ঞা পর্যালোচনা করলে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব যে, বাংলাদেশের জেলাপরিষদগুলো প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কি না।
নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বাংলাদেশের জেলাপরিষদগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নয় : বাংলাদেশের জেলাপরিষদগুলো তত্ত্বগতভাবে স্বশাসিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। কেননা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার কর্তৃক সৃষ্ট।
বাংলাদেশের সংবিধানে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা কী হবে, ক্ষমতা ও কার্যাবলি কী হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলার নেই।
তাই কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ইচ্ছামতো আইন পরিবর্তন বা সংশোধন করে জেলাপরিষদের ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে, এমনকি ক্ষমতা কেড়েও নিতে পারে।
এককথায় জেলাপরিষদের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জেলাপরিষদগুলো তত্ত্বগতভাবে স্বশাসিত হলেও প্রকৃতপক্ষে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নয় ।
২. জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান নয় : বাংলাদেশের জেলাপরিষদ আইনে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলোতে এখন পর্যন্ত সে ব্যবস্থা করা হয়নি।
জেলাপরিষদের চেয়ারম্যানগণ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন। এছাড়া অন্যান্য প্রতিনিধি সদস্যরাও সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন।
কোনোরূপ কারণ দর্শানো ব্যতীত সরকার যেকোনো সময় তাদের পদচ্যুত করতে পারেন। এককথায় জেলাপরিষদগুলোতে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই।
৩. জনগণের নিকট দায়ী নয় : বাংলাদেশের জেলাপরিষদগুলো সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত। এসব মনোনীত প্রতিনিধিরা কোনো দিক থেকেই জনগণের নিকট দায়ী নয়; বরং সরকারের নিকট দায়ী। সুতরাং জেলাপরিষদগুলো প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নয় ।
৪. প্রশাসনিক ক্ষমতা সীমিত : প্রশাসনিক দিক থেকেও জেলাপরিষদের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। জেলার কর্ণধার হিসেবে জেলা প্রশাসকই জেলার সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনার অধিকারী।
তাছাড়া বাংলাদেশের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ হলো স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এ বিভাগই জেলাপরিষদসহ সব স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক। এ দৃষ্টিকোণ থেকেও জেলাপরিষদকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করা যায় না ।
৫. আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় : জেলাপরিষদগুলো আর্থিক দিক থেকেও স্বাধীন নয়। জেলাপরিষদের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত প্রকট।
সরকারের অনুমতি ছাড়া জেলাপরিষদ নতুন কর ধার্য করতে পারে না। জেলাপরিষদগুলো যেসব খাত থেকে অর্থ উপার্জন করে সেগুলো যথেষ্ট নয়।
ফলে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদেরকে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বাজেট প্রণয়ন করা কিংবা তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।
এককথায় জেলাপরিষদগুলো আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় তাদেরকে সবসময় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় । সুতরাং জেলাপরিষদগুলো প্রকৃত অর্থে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জনগণের মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রভৃতি মিটানো জেলাপরিষদের পক্ষে তো সম্ভব নয়ই; বরং কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য নিয়েও তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না ।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেলাপরিষদকে গড়ে তুলতে হলে সেখানে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সর্বোপরি জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারলে জেলাপরিষদ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভে সক্ষম হবে।