বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বর্ণনা কর
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বর্ণনা কর |
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বর্ণনা কর
- অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আলোচনা কর ।
- অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিবরণ দাও ।
উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ও সরকারি প্রশাসনিক দফতরের মাঝে সমন্বয়ের ব্যাপক অভাব পরিলক্ষিত হয়।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া প্রভাবের ফলে স্থানীয় সরকার স্বাধীনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনগণ অংশ নিতে পারে না।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের হস্তক্ষেপে জনগণ স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিতে পারে না ।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া : জাতীয় উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের কার্যকারিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালীদের মতামতের প্রাধান্য বিস্তার করায় স্থানীয় সরকার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না।
আর এ সমস্যাটি শুরু হয় ‘স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯' পাস করার মাধ্যমে, যেখানে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় যথাক্রমে স্থানীয় সংসদ সদস্য,
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট। যার ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রভাব অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
নিম্নে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা দান : বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নের নিমিত্তে গঠিত সরকার ব্যবস্থা হওয়ার পরও জনগণের চাহিদানুযায়ী কোনো অনুকূল পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না ।
সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতিতে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক স্তরের কর্মকর্তা, যেমন— উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে।
তাই স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রমের পরিকল্পনা তারাই গ্রহণ করে। এ কারণে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের কর্তৃত্ব সীমিত। গ্রাম্য হাটবাজার, মেলা, ট্রেড লাইসেন্স প্রভৃতি থেকে রাজস্ব সংগৃহীত হয় তা দিয়ে স্থানীয় উন্নয়নের ৩%-৫% মাত্র পূরণ করা যায়।
কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্ব প্রয়োজন।
এ কারণে স্থানীয় উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল বলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না।
৩. স্থানীয় আমলাতন্ত্রে আনুগত্য : স্থানীয় আমলারা সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে।
যেমন— উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ওপর নামমাত্র প্রধান হিসেবে খুব সামান্যই কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারেন।
কিন্তু সেই অফিসারগণ আবার জেলা প্রশাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত নিয়মকানুন বাস্তবায়ন করে।
৪. প্রভাবশালীদের প্রভাব : কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা এবং নেতাকর্মীদের সাথে সম্পর্কিত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ স্থানীয় সরকারে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে নিম্নপদস্থ অংশীদার বলে মনে করেন।
ভাই স্থানীয় পর্যায়ে যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন তাদের অধিকাংশই স্থানীয় ধনী অথবা মধ্যম আয়ের পরিবার থেকে আসে, যা সমগ্র বাংলাদেশের অধিকাংশ ইউনিয়ন, থানা বা স্থানীয় সরকার প্রশাসনের বাস্তব চিত্র। ফলে স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না।
৫. যোগ্যতার অভাব : উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবে অধিকাংশ সময় তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করে।
এক্ষেত্রে তারা চেয়ারম্যানদের অগ্রাহ্য করে অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা অধিকাংশ সময় স্থানীয় জনগণের ওপর নির্ভরশীল থাকে।
এক্ষেত্রে চেয়ারম্যানদের অগ্রাহ্য করে অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা অধিকাংশ সময় স্থানীয় জনগণের বিপক্ষে যায়।
৬. স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ : সেন্টার ফর ডায়ালগ (CPD)-২০০০ এর মতে, স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এতে স্থানীয় সরকার জনগণের নিকট জবাবদিহির পরিবর্তে মন্ত্রণালয়ের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ২৫ ধারা অনুযায়ী, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবশ্যকীয়ভাবে স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
২০০৮ সালে এটি বাতিল করা হলেও ২০০৯ সালের আইনের মাধ্যমে তা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। এর ফলে স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। তাই সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
৭. ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মতামত : স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সমিতির মতে, স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থি হিসেবে কাজ করে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের স্থানীয় কর সংগ্রহে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকলেও এমপিদের দৌরাত্ম্যে তারা শুধু নির্বাক ভূমিকা পালন করে। এভাবে এমপিদের প্রভাব চলতে থাকলে ইউনিয়ন পরিষদের অস্তিত্ব একদিন বিলীন হয়ে যাবে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যেকোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নে স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে এমপি ও আমলাদের হস্তক্ষেপ এবং প্রভাবশালীদের প্রভাব স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে।
তাই স্থানীয় জনগণের কল্যাণের জন্য স্থানীয় সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না, যা পরোক্ষভাবে দেশের জাতীয় উন্নয়নকেই ব্যাহত করছে।
তাই স্থানীয় তথা জাতীয় উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে সরকারের উচিত হবে স্থানীয় সরকারের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করা।