বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা মূল্যায়ন কর



বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা মূল্যায়ন কর
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা মূল্যায়ন কর

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা মূল্যায়ন কর

  • অথবা, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের গুরুত্ব আলোচনা কর ।
  • অথবা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা বর্ণনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো জনগণের সর্বাধিক কল্যাণের জন্য সর্বদা প্রচেষ্টা চালায় । রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে এর কর্মপরিসরও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। 

এজন্য সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে কার্যসম্পাদনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্ম ও ক্ষমতাকে ভাগ করে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার হিসেবে জনগণের নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভিন্ন জটিল কার্যাদি সম্পাদন করে কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা : নিম্নে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা মূল্যায়ন করা হলো :

১. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা এটিই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি। 

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাওহরলাল নেহেরুর মতে, "স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারই হলো যেকোনো ধরনের গণতন্ত্রের মূলভিত্তি। গণতন্ত্রকে ভিত্তি থেকে গড়ে তোলা না হলে তা থেকে কার্যকারিতা লাভ করা যায় না।"

২. গণতন্ত্রের অগ্রগতি : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার শক্তিশালী হলে গণতন্ত্রের অগ্রগতি সাধিত হয়। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। 

কেননা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জনগণের সংশ্লিষ্টতা বেশি। তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার কাজ করে যাচ্ছে। 

৩. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

এটি গণতন্ত্রের সফলতার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। এটি জনগণকে দ্বীয় দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে।

৪. গণতান্ত্রিক শিক্ষার প্রসার : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে ভোটদাতা ও প্রার্থী উভয়ই গণতন্ত্র সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ করে। 

শিক্ষিত ব্যক্তি প্রার্থী সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে বুঝে তার ভোট প্রদান করে। অপরদিকে, অশিক্ষিত ব্যক্তি এসব বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। মোটকথা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষকে বাস্তব জ্ঞানদান করে।

৫. পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। এ সরকারের মাধ্যমে জনগণের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। 

এ সরকার জনগণ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ফলে সরকার সহজেই জনগণের নিকট সেবা পৌঁছে দিতে পারে। 

সরকার যেমনিভাবে জনগণের সহযোগিতা পায়, তেমনি জনগণ সরকারের কাছে তাদের সমস্যার কথা ব্যক্ত করতে পারে। এভাবেই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। 

৬. নেতৃত্বের বিকাশ সাধন : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য নেতৃত্বের বিকাশ সাধন করে। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে একজন নেতা পরবর্তীতে জাতীয় নেতা হিসেবে সমাদৃত হয়। 

এভাবেই গণতন্ত্রের ক্ষুদ্র প্রয়াস ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। সুদক্ষ নেতৃত্ব ব্যতীত অনেক মহৎ কর্মও ব্যর্থ হয়ে যায়। গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নেতৃত্বের বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। তাই একে নেতৃত্ব তৈরির কারখানা বলা হয়।

৭. গণতন্ত্রকে সুসংহতকরণ : গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র বিকশিত হয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চা আরও সহজতর হয়। 

৮. প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।- স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে। কেননা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করলে বাস্তবিক জ্ঞানলাভ করা যায় না।

৯. জনসাধারণের অংশগ্রহণ : জনগণ ছাড়া গণতন্ত্র মূল্যহীন। তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণের অংশগ্রহণ একান্ত আবশ্যক। স্থানীয় পর্যায়ে সমস্যা সমাধান এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ একান্ত আবশ্যক। 

গণতন্ত্রকে সম্প্রসারিত করতে বেশি পরিমাণে জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তাই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১০. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধন : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

অর্থনীতির অগ্রগতি ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে উৎপাদন বৃদ্ধি করে। 

এলাকার সার্বিক উন্নয়নে এ সরকার কাজ করে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের চাপ কমিয়ে সাহায্য করে এবং প্রশাসনিক খরচ কমাতে ভূমিকা পালন করে ।

১১. কর্ম বিভাজন : স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার কর্ম বিভাজনের মাধ্যমে কিছু দায়িত্ব স্থানীয় পর্যায়ে প্রেরণ করেছে। 

ফলে ক্রমশ জটিল হওয়া প্রশাসনের জটিল কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারকে একা করতে হচ্ছে। এজন্য গণতন্ত্রের বিকাশ সাধিত হচ্ছে। সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণকে পূর্বের ন্যায় হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না । 

১২. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ : ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হয়। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকলে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের উদ্ভব ঘটে। 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রসার নিশ্চিত করতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার একান্ত আবশ্যক। স্থানীয় প্রশাসন সবকিছুর উৎস । তাই এর উন্নয়ন ও প্রসার একান্ত কাম্য ।

১৩. জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ : প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সরকারের মূল আলোচ্য বিষয় হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। 

ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সহজতর হয়। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের কারণেই প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন । কেননা এর মাধ্যমেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ।

১৪. সময়ের মূল্যায়ন : সময়ের মূল্যায়ন ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । 

পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সব কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব থাকায় জনগণ প্রকৃত সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতো। 

পরবর্তীতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কর্ম ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। ফলে জনগণ প্রকৃত সেবা গ্রহণ করতে সমর্থ হচ্ছে।

১৫. সামাজিক উন্নয়ন : একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কেননা স্থানীয় প্রশাসন ব্যতীত রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা রয়েছে।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারের ভূমিকা অপরিসীম। কেননা সুপ্রতিষ্ঠিত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের অন্যতম পূর্বশর্ত। 

সর্বত্র গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url