সহজ ভাষায়: ব্যাকরণ কাকে বলে? ব্যাকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত

ভাষার মাধ্যমেই মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। ব্যাকরণ সেই ভাষাকে বিশ্লেষণ করে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে। আজকের ব্লগে আলোচনা বিষয় ব্যাকরণ কাকে বলে, ব্যাকরণ কত প্রকার ও কি কি, ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় কয়টি, ব্যাকরণ শব্দের অর্থ কি ও ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি টপিকের উপর।

নমস্কার! সবাই কেমন আছেন? আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন। 🥰আপনাদের আশীর্বাদে আমিও ভালো আছি। আজকের টপিকে আপনাকে স্বাগত! আমারলোড ব্লগে প্রযুক্তিগত আপডেট থাকতে গুগল নিউজে ★ Follow করুন।
ব্যাকরণ কাকে বলে

ব্যাকরণ কাকে বলে?

যে পুস্তকে ভাষার নিয়ম, শৃঙ্খলা ও নিয়মের বিশ্লেষণ সুষ্ঠুভাবে বর্ণনা করা হয় তাকে ‘ব্যাকরণ’ বলে। অন্য কথায় বলতে গেলে ভাষার গতি-প্রকৃতি, নিয়ম-শৃঙ্খলা, বিচার ও বিশ্লেষণ বিন্যাস করে যে গ্রন্থ তাকে ব্যাকরণ বলে।

অথবা, যে শাস্ত্রে কোনো ভাষার বিভিন্ন উপাদানের স্বরূপ ও প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয় তাকে ‘ব্যাকরণ’ বলে।

বিভিন্ন মনীষীর সংঙ্গা

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, যে শাস্ত্র পাঠ করলে ভাষা শুদ্ধরূপে লিখতে, পড়তে ও বলতে পারা যায় তাকে ব্যাকরণ বলে।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, যে শাস্ত্র কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ, প্রকৃতি ও প্রয়োগরীতি বুঝিয়ে দেয়, সেই শাস্ত্রকে বলে সে ভাষার ব্যাকরণ।

ড. মুনীর চৌধুরী এর মতে, যে শাস্ত্রে ভাষার বিশ্লেষণ দ্বারা ভাষাকে তার উপাদানসমূহের বিচার, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, যোগাযোগের প্রণালি এবং তাদের অশুদ্ধি ও বিশুদ্ধি নির্ণয় করা যায় তাকে ব্যাকরণ বলে।

ড. হুমায়ুন আজাদ এর মতে, ব্যাকরণ বলতে এমন এক পুস্তককে বুঝায় যেখানে একটি বিশেষ ভাষার যথাযথ প্রয়োগের নিয়ম-কানুন লিপিবদ্ধ থাকে।

ড. এনামুল হকের মতে, যে শাস্ত্রের দ্বারা ভাষাকে বিশ্লেষণ করে এর বিবিধ অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় এবং ভাষা রচনাকালে আবশ্যকমত সেই নির্ণীত তত্ত্ব ও তথ্য প্রয়োগ সম্ভবপর হয়ে ওঠে তার নাম ব্যাকরণ।

ব্যাকরণ বিশ্লেষণ

ব্যাকরণ শব্দটি মূলত সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ। একে বিশ্লেষন করলে পাওয়া যায় বি + আ + √কৃ + অন। ব্যাকরণ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ। ব্যাকরণের ইংরেজি শব্দ ‘Grammar’।

মানুষমাত্রই ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। ব্যাকরণ সেই ভাষাকে বিশেষভাবে বিচার- বিশ্লেষণ করে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে। বর্তমান বিশ্বে দেশ, জাতি, গোষ্ঠী ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন রকম ভাষা প্রচলিত আছে। যেগুলো প্রকৃতি ও ব্যবহার বিভিন্ন রকম। তাই ভাষার প্রকৃতি ও ব্যবহার অনুসারে একেক ভাষার জন্য একেকটি ব্যাকরণের সৃষ্ঠি হয়েছে।

যে ভাষার ব্যাকরণ যত বেশি চর্চা করা হয় সে ভাষা সম্পর্কে তত বেশি পান্ডিত্য অর্জন করা যায়। ব্যাকরণকে বলা হয় ভাষার সংবিধান। দেশের সংবিধান যেমন দেশকে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সুনির্দিষ্ট আইন-কানুন রয়েছে। তেমনি ব্যাকরণেও ভাষা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট আইন- কানুন রয়েছে। তাই ভাষা চর্চাকারী মাত্রেরই সেই ভাষার ব্যাকরণের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।

ব্যাকরণের বৈশিষ্ট্য

১. ব্যাকরণ ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়মরীতি আলোচনাকারী শাস্ত্র।
২. এটি ভাষার সংবিধান নামে পরিচিত।
৩. ব্যাকরণ ভাষাকে শাসন করে না, ভাষাই ব্যাকরণকে শাসন করে।
৪. ভাষার পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যাকরণের নিয়মও পরিবর্তন ঘটে।
৫. ব্যাকরণ ভাষাকে অনুসরণ করে, কিন্তু ভাষা ব্যাকরণকে অনুসরণ করে না।
৬. ভাষা সৃষ্টির অনের পরে ব্যাকরণ সৃষ্টি।
৭. ব্যাকরণের জ্ঞান ভাষার নির্ভুল ব্যবহার নিশ্চিত করে।

ব্যাকরণ কত প্রকার ও কি কি ?

ব্যাকরণের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্যাকরণকে চার ভাগে ভাগ করেছেন।

১. ঐতিহাসিক ব্যাকরণ।
২. তুলনামূলক ব্যাকরণ।
৩. বর্ণনামূলক ব্যাকরণ।
৪. দার্শনিক বিচারমূলক ব্যাকরণ।

নিচে বিভিন্ন শ্রেনীর ব্যাকরণের পরিচিতি আলোচনা করা হলো-

১. ঐতিহাসিক ব্যাকরণ: বাংলা ভাষার ভাষাংশ, ভাষার কালানুক্রমিক প্রবাহ, ভাষা পরিবর্তনের ইতিহাস, শব্দের শ্রেণিকরণ, পদ ও বিভক্তির ব্যুৎপত্তিগত বর্ণনা এবং বিশ্লেষণ রীতিকে ঐতিহাসিক ব্যাকরণ বলা হয়। বাংলা ভাষার অতীত রূপের বিচার-বিশ্লেষণ করাই ঐতিহাসিক ব্যাকরণের কাজ।
২. তুলনামূলক ব্যাকরণ: দূর কিংবা নিকট সম্পর্কিত দুই বা ততোধিক ভাষার সাথে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নিরুপণ করার রীতিকে তুলনামূলক ব্যাকরণ বলা হয়। এই রীতিতে ভাষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে প্রচলিত ধ্রুপদী ভাষা বা Classical Language ভাষার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
৩. বর্ণনামূলক ব্যাকরণ: একটি বিশেষ কালে প্রচলিত বাংলা ভাষায় বিচার-বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ সম্পর্কিত আলোচনাকে বর্ণনামূলক ব্যাকরণ বলা হয়। এই রীতিতে বাংলা ভাষার আদর্শ রূপের পাশাপাশি সেই ভাষার আঞ্চলিক রূপ গোষ্ঠীজাত বা ব্যক্তিগত প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করাই এ ব্যাকরণের কাজ।
৪. দার্শনিক বিচারমূলক ব্যাকরণ: ভাষামাত্রই মানুষের মস্তিষ্কের চিন্তাপ্রসূত এক ধরনের মানবিক ক্রিয়া। বাংলা ভাষা এর ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং, বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত চিন্তাপ্রণালি, আবিষ্কার ও কীভাবে ভাষার প্রায়োগিক অর্থের তারতম্য ঘটে সে সম্পর্কে যে ব্যাকরণ আলোচনা করে তাকে দার্শনিক বিচারমূলক ব্যাকরণ বলে।

ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়

ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় চারটি। সেগুলো নিচে দেওয়া হলো।

১. ধ্বনিতত্ত্ব।
২. শব্দতত্ত্ব।
৩. বাক্যতত্ত্ব।
৪. অর্থতত্ত্ব।

বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যতম ভাষা। এ ভাষার উল্লিখিত চারটি মৌলিক অংশ রয়েছে। নিম্নে আলোচনা করা হলো-

১. ধ্বনিতত্ত্ব: বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্ব অংশে- বর্ণ প্রকরণ, বর্ণের উচ্চারণ রীতি, বর্ণ সংযোগ, বর্ণ বিশ্লেষণ, সন্ধি, ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়।
২. শব্দতত্ত্ব: এক বা একাধিক ধ্বনির মিলনে গঠিত হয় শব্দ। প্রতিটি শব্দই ভাবের প্রতীক। বাংলা ব্যাকরণের শব্দতত্ত্ব অংশে- শব্দ গঠন, শব্দ প্রকরণ, পদ প্রকরণ অর্থাৎ পদ পরিচয়, লিঙ্গ, বচন, শব্দরূপ, কারক, সমাস, ক্রিয়ামূল বা ধাতুরূপ, ক্রিয়ার কাল, পুরুষ প্রত্যয় ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়।
৩. বাক্যতত্ত্ব: বাক্যতত্ত্ব অংশে বাক্যের প্রকার, গঠন, সংযোজন, বিয়োজন, বিশ্লেষণ, বাক্যের রীতি প্রয়োগ, বাগধারা ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়।
৪. অর্থতত্ত্ব: শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থবিচার, অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ যেমন- মুখ্যার্থ, গৌণার্থ, বিপরীতার্থক ইত্যাদি অর্থতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়।

ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা

ব্যাকরণই একমাত্র শাস্ত্র যা পাঠ করে ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠন প্রকৃতি ও সেসবের সুষ্ঠু ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এবং লেখার ও কথায় ভাষা প্রয়োগের সময় এর শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ধারণ করা যায়। ভাষা ও ব্যাকারণ একই সূত্রে গাঁথা। কোনো ভাষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হলে অবশ্যই ব্যাকরণ পাঠ করতে হবে।

ভাষা সৃষ্টির অনেক পড়ে ব্যাকরণের উদ্ভব। তাই ব্যাকরণ ছাড়া ভাষা একেবারে অচল একথা বলা যায় না। তবে ব্যাকরণ ছাড়া ভাষার আদর্শ মান বজায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যাকরণে সন্ধি, সমাস, প্রত্যয়, উপসর্গ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত রীতি-নীতি আলোচিত হয় বলে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করা যায়। যেগুলো ভাষাকে সমৃদ্ধ করে।

ব্যাকরনে কবিতার ছন্দ ও শব্দের অলঙ্কার সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠু আলোচনা স্থান পায়। এভাবে ভাষা উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে ব্যাকরণ পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।

ভাষা ও ব্যাকরণ

শরীর থাকলেই যেমন চিকিৎসা, তেমনি ভাষা থাকলেই ব্যাকরণ। অর্থাৎ, শরীর আগে চিকিৎসা বিদ্যা পরে, তেমনি ভাষা আগে ব্যাকরণ পরে। ভাষা আছে বলে ব্যাকরণ- ব্যাকরণ আছে বলে ভাষা নয়। ব্যাকরণ রচনা করা হয় ভাষাকে অনুসরণ করে, ব্যাকরণকে অনুসরণ করে ভাষা নয়। শরীর সুস্থ ও সবল রাখার জন্যে যেমন চিকিৎসা দরকার তেমনি ভাষা সুন্দরভাবে ব্যবহারের জন্যে ব্যাকরণ দরকার।

মোট কথা ভাষা ও ব্যাকরণ একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস

বাংলা ব্যাকরণ ইংরেজি আদর্শে রচিত। সুতরাং বলা যায় ইংরেজরা আগমনের পরেই বাংলা ব্যাকরণের উৎপত্তি হয়েছে। ম্যানোএলদ্য আসসম্পসাম নামক জনৈক বিদেশী বাংলায় প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন। ১৭৪২ সারে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রোমান হরফে লেখা এ ব্যাকরণখানি তিনি প্রকাশ করেন। তারপরে ১৭৭৮ সালের ইংরেজ পন্ডিত ন্যাথালিয়েন ব্রাসি হ্যালহেড নামক বিখ্যাত  এক ইংরেজি পন্ডিত প্রকাশ করেন “A Grammar of the Bengali Language.” এরপরে কেরী সাহেবের ব্যাকরণ ১৮০১ সালে বের হয়। 

১৮২০ সালে কীথ সাহেবের রচিত ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়। তখন এদেশের বাংলা ভাষাভাষী কোন পন্ডিত এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ১৮২৬ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। তার মৃত্যুর পর ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে এর বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়।

পরবর্তীতে নকুলেশ্বর, বিদ্যাভূষণ, আচার্য যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ পন্ডিতগণ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। এরপরে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ রচনা করেন এবং বাংলা ভাষার বহু বিতর্কিত বিষয়ের ‍উপর মূল্যবান মতামত রাখেন।




যদি এই ব্লগটি আপনাদের বিন্দুমাত্র কাজে লেগে থাকে বা উপকারে আসে তবেই আমাদের স্বার্থকতা। আপনাদের তথ্যের প্রয়োজন মেটাতে আমরা ব্লগিংয়ে নিযুক্ত। পরিচিত কাউকে এই তথ্য জানাতে শেয়ার করুন। আমারলোড ব্লগে এডুকেশন, জব সার্কুলার, ফ্রীল্যান্সিং, ও তথ্যমূলক ব্লগ পোস্টগুলি প্রচার করে থাকে। আরও জনপ্রিয় ব্লগ পড়তে নীচে স্ক্রোল করুন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url